একটি তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘোরের মধ্যে আধো অন্ধকার করিডোর ধরে হাঁটছি। বাংলা কবিতাসৌধের ভেতরে। দুই পাশে অসংখ্য দরজা। একটি দরজার সামনে উজ্জ্বল আলো। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছি। রুম কোথায়? এ যে বিশাল প্রান্তর। পাশে স্বচ্ছতোয়া ঢেউ খেলানো নদী। কে যেন ঢেউয়ের ছন্দ নকল করে মৃদুকণ্ঠে গেয়ে ওঠে, ‘বলল কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে, শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।’ আহা, তিতাস, তিতাস একটি নদীর নাম। মুহূর্তে সরে যাওয়া প্রতিটি ঢেউয়ের আড়ালে বুঝি এখনো উঁকি দিচ্ছেন অদ্বৈত মল্লবর্মন আর বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার মৃণাল ঘোষ। আমি তাদের অস্পষ্ট চেহারা দেখার জন্য চোখ বড় করে তাকাই। না, আরো একটি মুখ সেখানে মিটিমিটি হাসির আলোয় ঝিঁকিয়ে ওঠে। সেই আলোর পুচ্ছ অনুসরণ করতে গিয়ে হঠাৎ পিছলে যাই অনেকটা সময়। একটি প্রায়ান্ধকার টিনের চালার ঘর। ‘মনে কিসে খটকা’, ‘মনে কিসে খটকা’, এ রকম বোল তুলে অবিরাম চলছে একটি ছোট্ট ট্রেডল মেশিন। সাদা পাঞ্জাবি ও লুঙ্গিপরা চল্লিশোর্ধ কালো যে হালকাপাতলা লোকটি মেশিন চালাচ্ছেন তার মাথায় উল্টো ডিঙির মতো টুপি। কাজটা সেরেই জোহরের নামাজে যাবেন। কিছু খেয়েও নেবেন। আজ তার জন্য রুটি আর সবজি এনেছে তার তরুণ কাস্টমাররা। ছেলেগুলো খুব ভালো। সারা দিন মেতে আছে লেখাপড়া, সভা-সমিতি অথবা গানবাজনার অনুষ্ঠান নিয়ে। এবার তারা একটি লিফলেট ছাপতে এসেছে। সেটাই ছাপছেন তিনি। লিফলেটগুলো সুন্দর করে গুছিয়ে, একত্র করে, আলাদা আলাদা প্যাকেট করা হয়েছে। বিকেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায়। তারপর ছড়িয়ে পড়বে শহরে গ্রামে মানুষের হাতে হাতে। সে কাজটি করবে পিয়ারু, তাজুল, মুসা এবং আরো কয়েকজন। এরা সবাই শহরের লালমোহন স্মৃতি পাঠাগারের সাথে যুক্ত। একদিন আগে থেকে শুরু হয়েছে তাদের খরগোশ-ব্যস্ত তৎপরতা। টাকার জোগাড়, কাগজ কেনা, লিফলেটের ভাষ্য তৈরি, প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ তারা শেষ করেছে। এখন শরীর ক্লান্ত। সবাই বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে বিকেলে ফিরবে বাকি কাজ সারতে।